খেলানিউজফুটবল

রয়ে গেল ‘গোল অফ দ্যা সেঞ্চুরি’র স্মৃতি, জানুন কেমন ছিল ফুটবলের রাজপুত্রের বিতর্কে ভরা জীবন

Advertisement
Advertisement

বুধবার রাত্রে ৬০ বছর বয়সে প্রয়াণ হলো আর্জেন্টিনার প্রবাদপ্রতিম ফুটবলার তথা বিশ্বের ফুটবলের রাজপুত্র দিয়েগো মারাদোনার। আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনোস আয়ার্স এর টিগারে নিজের বাড়িতে এদিন হৃদরোগে আক্রান্ত হন মারাদোনা। এর আগে মস্তিষ্কে রক্তবদ্ধ হয়ে যাবার কারণে তার একবার অস্ত্রোপচার হয়েছিল। তারপর দুই মাস আগে তিনি তার বাড়িতে ফিরে ছিলেন। কিন্তু বুধবার সকালে তার আবারো একবার হার্ট অ্যাটাক হয়। কিন্তু এইবারে আর শেষ রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

Advertisement
Advertisement

মারাদোনা ১৯৮৬ বিশ্বকাপে তার দল আর্জেন্টিনার অধিনায়কত্ব করেছিলেন এবং সেই বছর আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে বিজয়ী হয়েছিল। ১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইতালিতে এবং সেখানে তিনি তার পায়ের অসামান্য স্কিল এর মাধ্যমে দুর্দান্ত কিছু গোল করে আর্জেন্টিনাকে বিজয়ী করেছিলেন। সেই বিশ্বকাপ জয়ের পরে তিনি হয়ে গেলেন বিশ্বের সবথেকে জনপ্রিয় ফুটবলারদের মধ্যে একজন। তার গোল স্কোর করার ক্ষমতা, বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়কে কাটিয়ে অসামান্য দক্ষতার মাধ্যমে বল জালে জড়িয়ে দেওয়ার স্কিল তাকে বিশ্বের অন্যতম বড় ফুটবলার এর মর্যাদা এনে দিয়েছিল।

Advertisement

২০০৫ সালে ব্রাজিলের স্বনামধন্য ফুটবলার জিকো বলেছিলেন,” মারাদোনা বিশ্বের সবথেকে বড় ফুটবলারদের মধ্যে একজন। এতে কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আমি মারাদোনাকে এমন কিছু জিনিস করতে দেখেছি, যা ভগবান অব্দি করতে দুইবার ভাববে।”

Advertisement
Advertisement

তবে নিজের কোকেন এর নেশার কারণে অবসর নেওয়ার পর থেকে মারাদোনার হার্টের সমস্যা সৃষ্টি হয়। অবসর গ্রহণের পর মারাদোনার অত্যন্ত ওজন বেড়ে যায় এবং ফিটনেস নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হতে থাকে। তারপর থেকে তার ফুটবল ক্যারিয়ার এবং জীবন সবকিছুতেই ডু অর ডাই পরিস্থিতি সামনে আসতে শুরু করে। তবে, সেই সমস্ত সমস্যাকে দূরে সরিয়ে রেখে ২০০৯ সালে মারাদোনা বলেছিলেন,”আমি হয় কালো হব না হলে সাদা, আমি কখনো ধূসর হব না।”

১৯৮৬ বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল – ‘ হ্যান্ড অফ গড ‘ –

আর্জেন্টিনার ‘গোল্ডেন বয়’ মারাদোনা সবথেকে বিখ্যাত তার ১৯৮৬ বিশ্বকাপের ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে করা দুটি গোলের জন্য। মেক্সিকো সিটিতে অনুষ্ঠিত হওয়া কোয়ার্টার ফাইনালে সকলেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন কে জিতবে তা দেখার জন্য। ব্রিটেন এবং আর্জেন্টিনার মধ্যে ফকল্যান্ডের যুদ্ধের ৪ বছর পরে এই কোয়ার্টার ফাইনাল অনুষ্ঠিত হচ্ছিল বিশ্বকাপের। মারাদোনার গোলে এই ম্যাচ হয়ে গেল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবল ম্যাচের মধ্যে একটি।

দ্বিতীয়ার্ধের ৬ মিনিটের মাথায় ইংল্যান্ডের স্টিভ হজ একটি ক্লিয়ারেন্স মিস করেন এবং সেই বল তার নিজের পেনাল্টি এরিয়ার দিকে পাঠিয়ে দেন। ৫ফুট ৫ ইঞ্চির মারাদোনা ৬ ফুটের ব্রিটিশ গোলকিপার পিটার শিল্টনের পাশ থেকে সেই বল জালে জড়িয়ে রচনা করলেন ইতিহাস।

রিপ্লে থেকে দেখা গিয়েছিল মারাদোনা হাত দিয়ে সেই বল ক্লিয়ার করেছিলেন তিনি মাথা দিয়ে গোল করেন নি। রেফারি এটিকে সম্পূর্ণ মিস করে এবং আর্জেন্টিনার ১০ নম্বর জার্সি প্লেয়ার মারাদোনা ” হ্যান্ড অফ গড ” হিসেবে এই গোল ডেডিকেট করেন।

গোল অফ দ্যা সেঞ্চুরি –

তবে মারাদোনার ওই গোল ক্রিকেট ইতিহাসের সবথেকে কুখ্যাত গোলের মধ্যে একটি হয়ে গিয়েছিল। তবে, ওই ম্যাচে মারাদোনার করা দ্বিতীয় গোলটি ২০০২ সালে ফিফাতে অনুষ্ঠিত হওয়া ভোটাভুটির মাধ্যমে বিংশ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ গোল হিসেবে চিহ্নিত হয়।

নিজের হাফের মধ্যে থেকে পাস কালেক্ট করার পরে মারাদোনা নিজের সর্বোচ্চ গতিতে ৪ জন ব্রিটিশ খেলোয়াড়কে কাটিয়ে শিলটনের পাশ থেকে তিনি বলটিকে সোজা জড়িয়ে দিলেন জালে। এই গোলটিকে দেখে কমেন্টেটর ভিক্টর হুগো মোরালেস বলে ওঠেন, ” আপনি কোন গ্রহ থেকে এসেছেন?”

২-১ গোলে এই জয়ের পরেই মারাদোনা এবং তার আর্জেন্টিনা দল ৩-২ গোলে পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে জিতে নেয় ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ।

চার বছর পরে আরো একবার আর্জেন্টিনা মারাদোনার নেতৃত্বে বিশ্বকাপ ফাইনালে উঠে কিন্তু এবারে তারা জার্মানির কাছে ১-০ গোলে হেরে যায়। লিওনেল মেসি এর মত দুর্দান্ত ফুটবলাররা থাকলেও আর্জেন্টিনা ১৯৮৬ এর পরে আর কোন বিশ্বকাপ জিততে পারেনি।

প্রথম জীবন –

৩০ অক্টোবর ১৯৬০ সালে বুয়েনস এ্যার্সে মারাদোনার জন্ম। বুয়েনোস আয়ার্স এর বস্তিতে একটি বল নিয়ে জাগলিং দেখানোর সময় তার ফুটবলের স্কিল প্রথমবারের জন্য দুনিয়ার চোখে পড়ে। ট্রেইনার ফ্রান্সিস্কো কর্নেজো প্রথমবার মারাদোনার এই স্কিল দেখতে পান এবং তাকে আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স এর দলের জন্য সাইন করেন। সেখানে তিনি ১৩৬টি ম্যাচ অপরাজিত ছিলেন।

তারপর মারাদোনা দেশের জন্য খেলতে নামেন ১৯৭৬ সালে ১৬ বছর বয়স্ হবার মাত্র ১০ দিন আগে। তারপর ১৯৭৮ থেকে পরপর ৩টি সিজনে তিনি আর্জেন্টিনার সর্বোচ্চ গোল স্কোরার ছিলেন। ১৯৮১ সালে তিনি যোগদান করেন বোকা জুনিয়রস দলে এবং সেই দল ওই বছর লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।

ক্লাব ফুটবল-

১৯৮২ সাল থেকে টানা ১১ বছরের জন্য মারাদোনা ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাবে ফুটবল খেলেছেন। প্রথমে তিনি যুক্ত ছিলেন ইউরোপের জনপ্রিয় দল বার্সেলোনার সাথে। তারপরে তিনি যোগ দেন নাপোলি দলে। বার্সেলোনা এবং নাপোলি দুটি দল তাকে সাইন করার জন্য রেকর্ড পরিমাণ টাকা খরচ করেছিল।

১৯৮৩ এল ক্লাসিকো –

১৯৮৩ এল ক্লাসিকোতে রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে খেতাব জয় করেছিল মারাদোনার দল বার্সেলোনা।

সেই প্রথমবার ছিল যখন রিয়েল মাদ্রিদের সমর্থকরাও বার্সার ফুটবলকে সম্মান করেছিলেন।

নাপোলিতে যোগদান –

৮ বছরে নাপোলি দলকে মারাদোনা এনে দিয়েছিলেন তাদের দুটি ইতালিয়ান টাইটেল এবং এই দলের একমাত্র ইউএফা কাপ।

তারপর থেকে, নাপোলি দল আর কোনদিন এই দুটি টুর্নামেন্ট জিততে পারেনি। এই কারণে নাপোলির ফুটবল প্রেমীদের কাছে মারাদোনা ভগবানের থেকে কিছু কম নয়।

বিতর্ক-

কিন্তু নাপোলি দলে থাকাকালীন সময়ে মারাদোনা কোকেনের নেশাগ্রস্ত হয়ে যান। ড্রাগ ব্যবহারের জন্য তাকে দীর্ঘ ১৫ মাস নির্বাসনে পাঠানো হয়। তারপর তিনি ১৯৯২ সালে সেভিলা চলে যান। তার ১ বছর পরে আবারও মারাদোনা আর্জেন্টিনাতে ফিরে আসেন।

কিন্তু বিতর্ক তার পিছু ছাড়েনি। ১৯৯৪ বিশ্বকাপে এপিহেড্রিন ব্যবহারের কারণে তাকে আবারো ১৫ মাসের জন্য নির্বাসনে পাঠানো হয়। আবার তিনি তার বুয়েনাস ইয়ার্স এর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রিপোর্টারদের উদ্দেশ্যে এয়ার রাইফেল চালিয়েছিলেন। তার জন্য তাকে হাজতবাস করতে হয়েছিল।

অবসর গ্রহণ-

১৯৯৭ সালে তিনি তাঁর কর্মজীবন শেষ করেন। তিনি তার সম্পূর্ণ ক্যারিয়ারে ৬৭৯টি ম্যাচ খেলে ছিলেন। এরমধ্যে ৩৪৬টি ক্লাব এবং ইন্টারন্যাশনাল গোল তিনি করেছিলেন।

মারাদোনা তার ক্যারিয়ারে ৪টি বিশ্বকাপ খেলেছিলেন। আন্তর্জাতিক স্তরে আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে মারাদোনা ৯১টি ম্যাচ খেলেছিলেন যেখানে তিনি ৩৪ টি গোল স্কোর করেছিলেন। তিনি ডান পায়ের থেকে বাঁ পা বেশি ব্যবহার করতেন।

আর্জেন্টিনার কোচ-

২০০৮ সালে মারাদোনা আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের কোচ হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। তারপর লিওনেল মেসির নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা দল ২০১০ বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেছিল। সেই দলের কোচ ছিলেন স্বয়ং মারাদোনা।

কোয়ার্টার ফাইনাল অব্দি খুব ভালোভাবে পৌঁছে গেলেও কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনা দল ৪-০ গোলে হেরে গিয়ে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয়। ২০১০ বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচেও আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ছিল মারাদোনার অত্যন্ত পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বী জার্মানি।

হেরে যাবার পরে মারাদোনা আর কখনো আর্জেন্টিনা দলের কোচিং করেননি। জীবনে বিতর্ক থাকলেও মারাদোনা মানুষের মনে চিরকাল চির নবীন হয়ে থেকে যাবেন।

Advertisement

Related Articles

Back to top button