অফবিট

বছরের শুরুতেই কলকাতার এই মন্দিরগুলো থেকে ঘুরে আসুন

Advertisement
Advertisement

শ্রেয়া চ্যাটার্জি : শীতের মৌসুম মানেই এখানে ওখানে বেড়াতে যাওয়া। তবে এদিক-ওদিক যাওয়ার থেকে আপনার যদি মনে হয়  ভগবানের দর্শন করবেন এই ছুটিতে, তাহলে আপনার জন্য বেশ কয়েকটি জায়গা রয়েছে তার মধ্যে থেকে বেছে নিতেই পারেন আপনার মনের মত জায়গা। আধ্যাত্মিক পীঠস্থানে পরিপূর্ণ  আমাদের পশ্চিমবঙ্গ। এখানে প্রতিটা দিন প্রতিটা ক্ষণে মানুষের মনে দেবদেবীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব থেকে যায়।  ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায়ে দেখে যা আলোর নাচন’ কালোর মধ্যে যে এত আলো তা না দেখলে বোঝা যায়না। আবার কালোর বিরহ জ্বালাও তীব্র। মা তো কখনও রুপাতিত, কখনও কালাতিত আবার কখন গুণাতীত। তাই বাহ্যিক জগতে মজে যাওয়া মন, মায়ের পায়ের আলোর নাচন দেখতে আকুল হয়।

Advertisement
Advertisement

নলহাটেশ্বরী : রামপুরহাট থেকে ১৪ কিমি দূরে নলহাটি। অনেকের মতে, এখানে দেবীর নলা পড়েছিল। এই নলা অর্থে কন্ঠনলা, অথবা কারুর কারুর মতে হাঁটুর নীচের  অস্থির অংশ হতে পারে। টিলার উপর চার চালার মন্দির। মন্দিরের গর্ভ তলে খোদাই করা দেবীর পাষাণ মূর্তি। প্রায় পাঁচশো বছর আগে স্মরণাথ শর্মা নামক সাধক স্বপ্নে দেবীর দেখা পান। তাঁর দ্বারাই দেবী র মাহাত্ম্য সারা দেশে প্রচারিত হয়। এখানে দেবী কালী রুপে বিরাজিতা। কালী অর্থে কাল হরন কারিণী। কালী রূপে দেবী মহা যোগেশের হৃদয়ে ডান পদ এবং মুলাধারে বাম পদ স্পর্শ করিয়ে নিজে জিহ্বা বার করে আছে। এই তিন বাহু হল এক মুলাধার গ্রন্থি, দ্বিতীয় হৃদয় গ্রন্থি ডান পদ, আর জিহ্বা গ্রন্থি। ধাপে  ধাপে সিঁড়ি উঠে গেছে। এক বেদীর উপর সিঁদুরে চর্চিত আধখানা চাঁদের আকারের একটা বড় পাথরের খন্ডই দেবীর প্রতিভূ।

Advertisement

আকালীর মন্দির : হাওড়া থেকে ট্রেনে নলহাটি, তারপর বারো কিমি বাসে ভদ্রপুর। সেখানে আকালীপুরে দেবী আকালী র মন্দির।  মহারাজ নন্দকুমারের স্বপ্নে পাওয়া দেবী এখানে মা কালী। সাপের উপর বসে সর্প সজ্জায় দেবী। দুই হাত,বরাভয়দায়িনী জগন্মাতা। দেবীর রূপটি প্রসন্ন।

Advertisement
Advertisement

কঙ্কালী পীঠ : এবার চলুন সাঁইথিয়া। মল্লারপুর থেকে মুহুর্মুহু বাস। দেবীর কাঁকাল বা কোমর পড়েছিল। দেবীর ত্রিশূল আর পটে কালী রূপী কঙ্কালী । এই পীঠ সংলগ্ন দুটি প্রস্ববন ধারায়ে পুষ্ট একটি কুণ্ড আছে। প্রচণ্ড গরমে যখন সব জায়গার জল শুকিয়ে যায় তখন এই কুণ্ডের জল শুকোয়ে না। শোনা যায় সুড়ঙ্গ পথে কাশীর মণিকর্ণিকা নদীর সাথে এঁর যোগ আছে। এখানে দেবীকে বাতাসা, কদমা আলতা দিয়ে পূজা দেওয়া হয়। এখানে বলি প্রথাও চালু আছে।

তারাপীঠ : বীরভূম জেলার রামপুরহাটে এটি একটি মন্দির নগরী। এটি দ্বারকা নদীর ধারে অবস্থিত। সতীর ত্রিনয়ন এই স্থানে পড়েছে। ঋষি বশিষ্ঠ প্রথম এই রূপটি দেখতে পান। উত্তর মূখী আটচালা মন্দির টি লাল ইঁট দিয়ে তৈরী

চারচালার উপর চারকোনে চারটি ছোট ছোট চূড়া আছে। মন্দিরের উত্তর ভিতের পূর্ব দিকে সীতাহরণ,রাম রাবনের যুদ্ধের চিত্র খোদিত।  বারো ফুট × ছয় ফুট মাপের মন্দিরের গর্ভগৃহ দেবীমূর্তি সংস্থাপিত। শিশু শিবকে স্তন্যপানরত তারার মূল মূর্তি। মূর্তি টি চতুর্ভুজা মুন্ডমালাধারিনী। মাথায় রূপার ছাতা। কপালে  সিঁদুর লেপা। ভক্তরা নারকেল, কলা, রেশমি শাড়ি দিয়ে পূজো দেন। ভক্তরা মন্দিরে প্রবেশের আগে জীবিত কুন্ড নামে জলাশয়ে স্নান করে মন্দিরে প্রবেশ করে।রোজ ই পশুবলি হয়। শহরের এক প্রান্তে একটি শ্মশান ঘাট।তন্ত্র মতে নরকঙ্কাল তারা মায়ের বিশেষ প্রিয়। এখানে বামাক্ষ্যাপার আশ্রম আছে।

মেলাইচণ্ডী : এবার যাওয়া যাক হাওড়া জেলার আমতায়।  মেলাই চণ্ডীর মন্দির টি দেবী জয়ন্তির পীঠস্থান। দামোদর নদীর পশ্চিম ধারে জয়ন্তী গ্রামে এখানে দেবীর মালাই চাকি পড়েছিল। মনে করা হয় এই মালাই কথাটি থেকেই মেলাই শব্দটির উৎপত্তি।আর চণ্ডীও দুর্গার আরেক রূপ। চণ্ডাসুরকে বধ করে দেবী চণ্ডী নাম ধারন করে। দেবী এখানে বরাভয়ের মাধ্যমে সাধক কে পথ থেকে মহাপথের উদ্দ্যেশে এগিয়ে নিয়ে যায়।তাই হে চণ্ডী তোমার চরনে কোটি কোটি প্রনাম। নম চণ্ডী নম চণ্ডী নম চণ্ডী।

দামোদরের তীরেই দেবীর মন্দির ছিল, তন্ত্র সাধক জটাধারী চক্রবর্তী এখানে পুজা করতেন। নদীর দিক পরিবর্তনের কারনে আমতা ও জয়ন্তী গ্রামের মাঝখান দিয়ে নদী বইতে লাগলো।পুজারী নদী পার হয়ে পুজা করতে আসতেন। বর্ষার ভিসনা নদিতে নৌকা না পেলে কুমির পিঠে করে তাকে পারাপার করে দিত। এমন অলৌকিক ব্যাখ্যাও শোনা যায়। বর্তমানে আমতার হাট তলায়ে এই মন্দির। লবন ব্যাবসায়ী কৃষ্ণ চন্দ্র দত্ত এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।মেলাই মা এখানে শিলা রূপে সোনার চোখ মুখ খোদিত। লাল বস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদিতা ও স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিতা। বুদ্ধ পূর্ণিমায়ে মন্দির স্থাপন দিবসে দেবীর উদ্দ্যেশে ছাগ বলির রীতি আজও বর্তমান। নিত্য ভোগে মাছ দেওয়া হয়।

কালীঘাট : কালীমাতা, কালীঘাট, কলিকাতা এই তিনটি শব্দ একে অন্যের পরিপূরক। কালীঘাট বলতে শুধু কালীঘাট স্থানটুকুই নয় উত্তরে দক্ষিনেশ্বর থেকে বর্তমানে বেহালা পর্যন্ত ধনুকাকার গঙ্গা তীরবর্তী অংশ কাশীর মতো পুণ্যভূমি ও পীঠস্থান। এই স্থান নিয়ে অনেক গল্প শোনা যায় ,এক তপস্বী এখানে সাধনা করতেন। এক সন্ধ্যায় তিনি  ভাগীরথীর জলে এক অদ্ভুত আলো দেখতে পান। তিনি জল ও স্থলের সংযোগ স্থলে এক শিলা খণ্ড লক্ষ্য করেন। সাধু দেখেন সেই শিলা খণ্ডের গায়ে মায়ের পায়ের আঙ্গুলের ছাপ। এখানে যা সতী পীঠ স্বয়ং দেবী তাকে জানান। তবে এই বক্তব্য নিয়ে মত পার্থক্যও দেখা যায়। মাতৃ আঙ্গুলির প্রথম দর্শক ছিলেন বর্তমান মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা সাবর্ণ চৌধুরীরা। কলকাতার প্রান পীঠ এই কালী ঘাট ।এখন মন্দির ট্রাস্টির অধীনে। আধ্যাত্মিক ঐতিহাসিক মন্দির হিসাবে এই মন্দিরের গুরুত্ব আছে।

সদা কালী কালী কালী বল মন 

কালী নাম স্মরনে হয় কালের দমন।

কাল অর্থে শ্বাস কারন এই জীব জগতে প্রতিটি মানুষ নির্দিষ্ট সংখ্যক শ্বাসের পুজি নিয়ে আসে। সেই পুজির অন্ত হলে তাকে ভব সংসার হতে চলে যেতে হয়।

মঙ্গল চণ্ডী : এবার বর্ধমানে সতীর আরেক পীঠ মঙ্গল চণ্ডী। যা বর্ধমানের কগ্রামে অবস্থিত। এখানে দেবীর বাম কনুই পড়েছিল। শ্রীমন্ত সদাগর বানিজ্য তরী নিয়ে সিংহলের পথে যাচ্ছিলেন। যাত্রা পথে বানিজ্য তরী ডুবে যায়। সিংহল বন্দরে সাঁতরে উঠলে সিংহল রক্ষীরা তাকে কারারুদ্ধ করে। কারাগারে থাকাকালীন তিনি মঙ্গলচণ্ডীর বন্দনা করেন। পুজায় সন্তুষ্ট হয়ে দেবী তাকে মুক্ত করেন। এই ভাবে দেবীর মাহাত্ম্য প্রচারিত হয়। দেশে ফিরে সওদাগর মায়ের পূজার প্রচলন করেন। এই দেবী রিপু সকলকে দমন করে অসুর প্রবৃত্তি নাশ করেন। তিনি কাল কে ধারন করে আছেন তাই তিনি কালী।

শেষ কথা : শুধু পশ্চিম বঙ্গ নয়,সারা ভারতবর্ষ ই হল আধ্যাত্মিক মহা পীঠস্থান। ঈশ্বর সর্ব ভুতে বিরাজমান।তিনি বলেছেন ‘ওরে মুগ্ধ জীব তোকে যান দেখবি আমি তোর মধ্যে তুই হয়ে আছি তুই আমি ময়’। তিনি সবার ভিতরে বাস করেন। তিনি   হৃদয় বাস করে জীব জগতকে নাচিয়ে চলে ছেন। আমরাও নাচছি। মোহের পিছনে ছুটে বেড়াচ্ছি। কালী প্রসঙ্গ যখন বললাম সাধক শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের নাম করতেই হয়। তিনি ছিলেন কালী মায়ের একনিষ্ঠ সাধক। তার দ্বারা ও কালীর মহিমা দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

Advertisement

Related Articles

Back to top button