প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শারীরিক অবস্থার আকস্মিক অবনতি শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে তাঁর শরীরের অবনতি হতে শুরু করে। এই মুহূর্তে সৌমিত্রবাবুর মস্তিষ্কের স্নায়ু প্রায় অচল হয়ে গেছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সৌমিত্রবাবুর ইইজি রিপোর্ট অত্যন্ত খারাপ এসেছে। তাতে দেখা গেছে, তাঁর মস্তিষ্কে ক্রমশ ব্রেন ডেথ-এর পরিস্থিতি তৈরী হচ্ছে। সৌমিত্রবাবুর জন্য গঠিত মেডিক্যাল টিমের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন , এই মুহূর্তে গ্লাসগো কোমা স্কেল অনুযায়ী সৌমিত্রবাবুর মস্তিষ্ক সূচক 5-এ নেমে গেছে। মেডিক্যাল সায়েন্স অনুযায়ী মস্তিষ্ক সূচক 3 হয়ে গেলে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর ব্রেন ডেথ ঘোষণা করা হয়।
চিকিৎসকদের বক্তব্য অনুযায়ী, এই মুহূর্তে সৌমিত্রবাবুর শারীরিক পরিস্থিতি অত্যন্ত সঙ্কটজনক। সৌমিত্রবাবুর হার্ট, লিভার ও কিডনি ঠিকমতো কাজ করছে না। শারীরিক পরিস্থিতি ক্রমশ এগোচ্ছে ‘মাল্টি অর্গ্যান ফেলিওর’-এর দিকে। সৌমিত্রবাবুর শরীরে সোডিয়াম ও পটাশিয়াম লেভেলের তারতম্য দেখা দিয়েছে। বুধবার তাঁর ট্র্যাকিয়োস্টমি করা হয়েছে। বেলভিউ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার সৌমিত্রবাবুর ডায়ালিসিস করা হলেও তেমন লাভ হয়নি। বরং তাঁর কিডনির অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে। এই মুহূর্তে ইউরিন আউটপুটের সমস্যা থাকার কারণে সৌমিত্রবাবুর শরীরে ইউরিয়া ও ক্রিয়েটিনিন অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাঁর হার্টরেট অনিয়মিত হয়ে গেছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে বর্ষীয়ান অভিনেতার শরীরে অক্সিজেনের অভাব হওয়ার ফলে তাঁকে একশো শতাংশ ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছে। ইতিমধ্যেই রাজ্য সরকারের তরফে পাঠানো চিকিৎসক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বেলভিউ হাসপাতালে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্য গঠিত বিশেষ মেডিক্যাল টিম। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সৌমিত্রবাবুর শরীরে একদিন অন্তর ডায়ালিসিস ও প্লাজমাফেরেসিস করা হবে। শুক্রবার ডায়ালিসিস করার পর শনিবার হবে প্লাজমাফেরেসিস। রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ সৌম্য মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, সমস্ত সতর্কতা বজায় রেখে সৌমিত্রবাবুর শরীরে প্লাজমাফেরেসিস করা হবে। তবে আগামী 12 থেকে 24 ঘন্টা সৌমিত্রবাবুর শারীরিক পরিস্থিতির পক্ষে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ সময় বলে ঘোষণা করেছেন চিকিৎসকরা।
ইতিমধ্যেই সৌমিত্রবাবুর পরিবারকে কাউন্সেলিং করা হয়েছে। কিছুদিন আগে তাঁর মেয়ে পৌলমী দেখা করেছিলেন বাবার সাথে। তবে সৌমিত্রবাবু কোনো কথা বলতে পারেননি। গত 6 ই অক্টোবর করোনা সংক্রমণ নিয়ে বর্ষীয়ান অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ভর্তি হন বেলভিউ হাসপাতালে। 2006 থেকে সিওপিডির সমস্যা থাকায় ও করোনা সংক্রমণের ফলে তাঁর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। সিটি স্ক্যান করে তাঁর বুকে কিছু না পাওয়া গেলেও এমআরআই রিপোর্টে জানা যায় তাঁর মস্তিষ্ক ও ফুসফুসে পুরানো ক্যান্সারের সংক্রমণ শুরু হয়েছে। তাঁর মূত্রথলিতে সংক্রমণ ধরা পড়ে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী সৌমিত্রবাবুর শরীরে দুই বার প্লাজমা থেরাপির প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু তাঁর শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়নি। তাঁর হার্টরেট অনিয়মিত হয়ে যায়। সৌমিত্রবাবুর শরীরে সোডিয়াম ও পটাশিয়াম লেভেলের তারতম্য ঘটে। তাঁর করোনা এনসেফ্যালাইটিস দেখা দেয়। সৌমিত্রবাবু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে যান। এমনকি তাঁর শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা ক্রমশ কমতে থাকে ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বাড়তে থাকে। ফলে তাঁকে বাইপ্যাপ ভেন্টিলেশন সাপোর্ট দেওয়া হয়। এরপর তাঁর করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ এলে চিকিৎসকরা তাঁর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা শুরু করেন। অ্যান্টিবায়োটিকের প্রভাবে প্রবীণ অভিনেতার তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব কিছুটা কাটলেও তিনি প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়েন। সৌমিত্রবাবু উঠে বসতে পারছিলেন না। এমনকি তিনি কথা বলতে বা মুখ দিয়ে খেতে পারছিলেন না। রাইলস টিউবের মাধ্যমে খাওয়ানো হচ্ছিল তাঁকে। সৌমিত্রবাবুর ফিজিওথেরাপি ও স্পিচ থেরাপির চেষ্টা করা হলেও লাভজনক ফল হয়নি। তবে তাঁর শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা ক্রমশ স্বাভাবিক হচ্ছিল। ফলে তাঁর বাইপ্যাপ সাপোর্ট সরিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু সৌমিত্রবাবুর বয়সের পক্ষে স্টেরয়েডের ডোজ ক্ষতিকর হতে পারে, এই কারণে তাঁর শরীরে স্টেরয়েডের ডোজ কমিয়ে দেওয়া হয়। ফলে সৌমিত্রবাবুর স্নায়বিক সমস্যা জটিলতর আকার ধারণ করে। তিনি অচেতন হয়ে যান। সৌমিত্রবাবুর দুটি কিডনি বিকল হয়ে যাওয়ার ফলে তাঁর ইউরিন আউটপুট কমে যায়। তাঁর অন্ত্রে রক্তক্ষরণের কারণে শরীরে হিমোগ্লোবিন ও প্লেটলেট কমে যায়। ফলে সৌমিত্রবাবুকে রক্ত দিতে হয়। সৌমিত্রবাবু আর্টিস্ট ফোরামের সভাপতি। সৌমিত্রবাবুর শরীরে রক্তের প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায় রেখে আর্টিস্ট ফোরামের তরফ থেকে রক্তদানে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে বলা হয়েছে। মুম্বই থেকে অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্বাস্থ্যের খোঁজ নিয়েছেন এবং দ্রুত আরোগ্য কামনা করে বার্তা দিয়েছেন। অপরদিকে অনৈতিক ভাবে সৌমিত্রবাবুর নামে ভুল খবর ও তিনি আইসিইউ-তে থাকাকালীন লুকিয়ে তোলা তাঁর কিছু ছবি নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। সৌমিত্রবাবুর কন্যা পৌলমী সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে অভিনেতার ব্যক্তিগত পরিসর লঙ্ঘন ও মর্যাদাহানি না করার অনুরোধ জানিয়েছেন।