দুদিনের রাস উৎসবে মেতে উঠেছে দাঁইহাট

Advertisement

Advertisement

গৌরনাথ চক্রবর্ত্তী, দাঁইহাট, পূর্ব বর্ধমানঃ আজ থেকে প্রায় ১৩০০বছর আগে দাঁইহাট ছিল ইন্দ্রাণী নদীর ব-দ্বীপ অঞ্চল। এখানে রাজা ইন্দ্রদুম্ন একটি ইন্দ্রেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কথিত আছে, সচীদেবী এখানে তপস্যা করে দেবরাজ ইন্দ্রকে পতীরুপে পেয়েছিলেন। তাই এই জায়গা শাক্ত হিন্দুদের কাছে প্রয়াগ তুল্য। তাই এখানে সেই সময় থেকেই শাক্ত তান্ত্রিকদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

Advertisement

তারা এই এলাকায় পটে শাক্ত দেব-দেবীদের ছবি এঁকে কার্তিক পূর্ণিমার সংলগ্ন দ্বিতীয়ার দিন খুব জাঁকজমক করে শোভাযাত্রা বার করত।পূর্ণিমায় পূজো হত, তাই এই পূর্ণিমাকে পট পূর্ণিমা বলা হয়।শোভাযাত্রায় ঢাক, ঢোল, কাঁসর, মশালের আলো সহযোগে মানুষের সঙ বার হত। ১৪৮৬ খ্রীস্টাব্দে শ্রীচৈতন্যেদেবের জন্ম হয়।তার প্রচারিত বৈষ্ণব ধর্ম দাঁইহাট ও তার পাশ্ববর্তী এলাকায় যথেষ্ট প্রভাব ফেলে।

Advertisement

সমকালীন সময়ে দাঁইহাট ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, যোগাযোগ ও বসবাসের উল্লেখযোগ্য একটি ক্ষেত্র। এ অঞ্চলে বহুস্বনামধন্য ব্যবসায়ী ও জমিদার তাদের গঙ্গাবাস, কাছাড়িবাড়ি ইত্যাদি নির্মাণ করেন। এমনই একটি বংশ হল চন্দ্রবংশ। চন্দ্রেরা শান্তিপুরের চাকাফেরা গোস্বামীদের কাছে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা নেন। বৈষ্ণবরা কার্তিক পূর্ণিমায় শারদ রাস পালন করেন।

Advertisement

ব্যাসদেব পুত্র ঋষি শুকদেবের লেখা ভাগবত পুরাণে পাওয়া যায়, ঐদিন শ্রীকৃষ্ণ রাধা ও গোপনীদের সঙ্গে চক্রাকারে হল্লিকনৃত্যে মাতেন।একেই রাসযাত্রা বলা হয়।চন্দ্ররাও দাঁইহাটে রাসযাত্রা নির্মাণ করেন এবং বৈষ্ণবীয় রাস প্রচলন করেন।দাঁইহাট তখন থেকেই হয়ে উঠল শাক্তের পটপূর্ণিমা আর বৈষ্ণবের রাসপূর্ণিমার মিলন ক্ষেত্র। আজ পট পূর্ণিমার নামটি অবলুপ্তি হয়েছে ঠিকই।

কিন্তু বৈষ্ণবীয় রাসের সঙ্গে আজও বহু শাক্ত দেবদেবী শোভাযাত্রা য় বের হন।হিন্দুধর্মের দুই সম্প্রদায়ের মিলন উৎসব আজ দাঁইহাটের গৌরব। প্রায় ৬৩টি পুজো কমিটি এখনও তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।

দাঁইহাটের সাহাপাড়া নাগরিক মঞ্চ এবার দর্শকদের বরফের দেশ দেখার সাধ মেটাচ্ছেন। এখানকার থিম ‘সিমলার বরফের দেশে’ আছে কুকুরে টানা স্লেজ গাড়ি, ইগলুর মতো বরফ সাম্রাজ্যের নানান বৈশিষ্ট্য। দাঁইহাটের রাসের আকর্ষণ বাড়াতে ৩২টি জীবন্ত মডেলের মাধ্যমে প্রীতম ক্লাব গড়ে তুলেছে ‘মানসিক হাসপাতাল’। বিবেকানন্দ ক্লাব এবার বানিয়েছে পেল্লায় কদম ফুল। সেই ফুলের ওপর মণ্ডপ গড়ে তৈরি করা হয়েছে ভ্রমরকুঞ্জ।

সেখানে ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে ভ্রমরের দল নেচে নেচে মধু সংগ্রহ করছে। গঙ্গা রোডের রেড সান ক্লাবের মণ্ডপসজ্জায় শোভা পাচ্ছে গেরস্থর লুপ্তপ্রায় উপকরণ, বাঁশের ঝুড়ি, কুলো, ঝাঝুড়ি, কুলো। মাতঙ্গিমাতা পুজো কমিটির মণ্ডপের থিম বিশাল মন্দির। আর পরিবেশ ভাবনাকে গুরুত্ব দিচ্ছে দেওয়ানগঞ্জ ইন্দিরা স্মৃতি সঙ্ঘ। গাছগাছালির সবুজ আর পাখপাখালির কলতানে মুখর হয়েছে মণ্ডপ।টাউন ক্লাবের বিশাল প্যাণ্ডেল সকলের নজর কাড়ছে।জিতেন্দ্র স্মৃতি সংঘের বিশাল মণ্ডপও সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।গণপতি ক্লাবের পুজো,বৌদ্ধ সংঘের পুজো,বান্ধব সংঘের পুজোও নজর কেড়েছে।

দাঁইহাটের রাসে শুধু সংশ্লিষ্ট কাটোয়া মহকুমাই নয়, লাগোয়া নদীয়া জেলা থেকেও বহু মানুষের ঢল নামে। রাস উৎসব নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে ইতিমধ্যেই পুলিশ–প্রশাসন, পুরসভা ইতিমধ্যেই বৈঠক করেছে। পূর্ব বর্ধমান জেলা পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখার্জি এখানে এসে রোড ম্যাপ প্রকাশ করে গিয়েছেন। শাক্ত মতে পুজোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, শবশিব, বড়কালী, কায়েতকালী, গণেশ জননী, উগ্রচণ্ডী, কাত্যায়নী, আনন্দময়ী প্রভৃতি। দাঁইহাটবাসী শবশিবকে খুবই জাগ্রত বলে মানেন। শবশিব হলেন রাজবংশী সম্প্রদায়ের উপাস্য।

এই সম্প্রদায়ের ভগীরথ সিংহ নামে এক তন্ত্রসাধক এই শবশিব পুজোর সূচনা করেন।এখানে সকাল থেকেই মানুষের ঢল নেমেছে। বড়কালী হচ্ছেন ভাস্কর সম্প্রদায়ের। এখানে রয়েছে পঞ্চমুণ্ডের আসন। বড়কালীর মন্দির ও লাগোয়া ভৈরব শিব মন্দির সংস্কার করে দেয় বর্ধমানের রাজ পরিবার। আর থিমের রমরমার পুজোগুলি বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের পুজোর সূত্র ধরেই।

বর্তমানে ব্রাসব্যাণ্ড, ক্লাবব্যাণ্ড, তাসা, টগর ও বিভিন্ন লোকনৃত্য সহকারে শোভাযাত্রা বের হয়। চন্দননগর ও বিভিন্ন জায়গা থেকে আনা অত্যাধুনিক আলোকসজ্জা রাসপূর্ণিমার শোভাযাত্রাকে আলোর রশনায়ে ভরিয়ে দেয়। উপস্থিত দর্শক ও উদ্যোক্তাদের উদ্দীপনা দেখার মত।

Recent Posts