সাধারণ মানুষের লক্ষ লক্ষ টাকা চুরি করেছেন দেবাঞ্জন, দেখুন ভুয়ো অফিসারের উত্থান কাহিনী

কলকাতা পুলিশের তদন্তে একাধিক চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসছে দেবাঞ্জনের জেরার পরে

Advertisement

Advertisement

কসবার জাল ভ্যাক্সিনেশন কাণ্ডের তদন্ত যতই এগোচ্ছে ততোই বেরিয়ে আসছে দেবাঞ্জন এর ব্যাপারে নতুন নতুন তথ্য। এই দেবাঞ্জন হঠাৎ করেই একজন ভুয়ো আইএএস অফিসার হয়ে যাননি, এর শিকড় রয়েছে অনেক গভীরে। আদতে দেবাঞ্জন কিন্তু একজন আইএএস পরীক্ষার্থী ছিলেন কিন্তু ইউপিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। কিন্তু, বাড়ির কাছে নিজের সম্মান রাখার জন্য তিনি প্রথম মিথ্যে বললেন। তিনি জানালেন তিনি ইউপিএসসি পরীক্ষায় পাশ করে গিয়েছেন এবং তিনি আইএএস অফিসার হয়ে কাজ করতে শুরু করেছেন। সেই সময় মিউজিক ভিডিও এবং অন্যান্য কিছু ভিডিও পরিচালনার কাজ করতেন দেবাঞ্জন। কিন্তু প্রথম থেকেই সামাজিক কাজ করতে চেয়ে ছিলেন তিনি, এমনটাই তার দাবি।

Advertisement

কিন্তু সামাজিক কাজ করার জন্য, ততটা টাকা কিংবা প্রভাব-প্রতিপত্তি তার নেই। তাই এবারে তিনি শুরু করলেন নিজের মিথ্যের খেলা। প্রথমে তিনি নিজেকে একজন উঁচু দরের আইএএস অফিসার হিসেবে দাবি করতে শুরু করলেন। জানা যাচ্ছে পরবর্তীতে তিনি নিজেকে কলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের একজন যুগ্ম সচিব হিসেবে ও দাবি জানাতে শুরু করেন। শাসক দলের নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে তার। সোশ্যাল মিডিয়াতেও তিনি তার জাল তৈরি করা শুরু করেছিলেন। তার এই প্রচারকে আসলে রূপ দেবার জন্য তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন নেতাদের সঙ্গে ছবি পোস্ট করতেন।

Advertisement

যখন করোনা ভাইরাসের আক্রমণ শুরু হলো তখন একটি ব্যবসা ফেঁদে বসলেন দেবাঞ্জন। মাস্ক এবং স্যানিটাইজার এর ব্যবসা। বাগরি মার্কেট এবং মেয়েটা বিল্ডিং থেকে অনেক কম দামে বেশকিছু মাস্ক তুলে নিলেন দেবাঞ্জন। ভাড়া নিলেন গোডাউন, তার পরিবেশ ভালো দামে ওই মাস্ক এবং স্যানিটাইজার বিক্রি করতে শুরু করলেন। লাভের অংক টা ছিল দুর্দান্ত। কিন্তু তখনও পর্যন্ত তিনি শুধুমাত্র একজন আইএএস অফিসার, তিনি নিজেকে তখন ও কলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের যুগ্ম সচিব হিসেবে পরিচয় দেননি।

Advertisement

কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষ তার কাছে আসতে শুরু করে। সবাই মনে করতে থাকে দেবাঞ্জনের কাছে গেলে সাহায্য পাওয়া যাবে। এমনকি দেবাঞ্জন নিজেও তাদের জানান, তিনি তাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তারপর থেকেই তিনি নিজেকে কলকাতা পুরসভার যুগ্ম সচিব হিসেবে পরিচয় দিতে থাকেন। তিনি একটি কালো রঙের ইনোভা গাড়ি ভাড়া করেন, যার জন্য তিনি মাসে ৫২ হাজার টাকা পেমেন্ট করতেন। এছাড়াও কসবা এলাকায় তিনি একটি অফিস ভাড়া করেন এবং সেখানে বেশ কয়েকজন কর্মী নিয়োগ করেন।

সেই মুহূর্তে বেশ কয়েকজন কন্ট্রাক্টর এবং সাব-কন্ট্রাক্টর এর সংস্পর্শে আসেন দেবাঞ্জন। তাদের থেকে টাকা হাতানোর পরিকল্পনা শুরু করেন তিনি। এদের মধ্যে একজন আবার দেবাঞ্জন এর বিরুদ্ধে ১০ টাকা লুট করার অভিযোগ এনেছেন। তিনি জানিয়েছেন দেবাঞ্জন তাকে কলকাতা পুরসভার একটি টেন্ডার দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তার থেকে টাকা গ্রহণ করে। এই একই অভিযোগ করেছেন আরও এক কন্ট্রাক্টর তবে তার অভিযোগে টাকার অংকটা আরো বড়, ৯০ লক্ষ। ওই ব্যক্তি অভিযোগ জানান, দেবাঞ্জন তাকে একটি স্টেডিয়াম তৈরি করার টেন্ডার দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তার কাছ থেকে কত টাকা আত্মসাৎ করেছে।

পুলিশের ধারণা ওই টাকা দিয়ে তিনি অফিসের ভাড়া, কর্মীদের মাইনে এবং তার গাড়ির ভাড়া দিতেন। ভালোই চলছিল, কিন্তু বিপদটা হলো যখন করোনা ভাইরাসের সেকেন্ড ওয়েভ এলো। সেই সময় তার কর্মীরা ওয়ার্ক ফ্রম হোম করার দাবি জানাতে থাকে। সেই সময় দেবাঞ্জন তাদেরকে আশ্বাস দেন, তিনি সমস্ত ব্যবস্থা করে দেবেন এবং তাদেরকে তিনি ভ্যাক্সিনেশন করে দেবেন। যেখানে সরকারের কাছেই ভ্যাকসিন নেই, সেখানে দেবাঞ্জন কিভাবে ভ্যাকসিন পেয়ে যাচ্ছেন? যদিও অনেকেই মনে করতে শুরু করেন দেবাঞ্জন ভ্যাকসিন জোগাড় করে দিতে পারবেন। তারপর ধীরে ধীরে নিজের মিথ্যের জালে নিজেই জড়িয়ে পড়তে শুরু করেন দেবাঞ্জন।

দেবাঞ্জন জানিয়েছেন, এতদিন পর্যন্ত তিনি কলকাতায় দুটি জায়গায় ভ্যাক্সিনেশন ক্যাম্প করেছেন। একটি হলো কসবা এলাকায় যেখানে ইতিমধ্যেই সাড়ে ৫০০ জনের বেশি মানুষকে ভ্যাক্সিনেশন করা হয়েছে। অন্য জায়গাটি হল কলকাতার সিটি কলেজ যেখানে ইতিমধ্যেই ৭২ জনের ভ্যাকসিনেশন করা হয়েছে। তবে সংখ্যাটা বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে পুলিশ। যদিও দেবাঞ্জন জানিয়েছেন তার কাছে এখন আর তেমন কোনো টাকা বাকি নেই, তবুও পুলিশ তার প্যান নম্বর দিয়ে তার সমস্ত ব্যাংক একাউন্টের খোঁজ চালানো শুরু করেছে। দেবাঞ্জন আরও জানিয়েছেন তিনি নাকি বেহালা এলাকায় একটি খিচুড়ি বিতরণ ক্যাম্প করেছিলেন। এই বিষয়টির তদন্ত করছে পুলিশ।

দেবাঞ্জন এর বাড়ি থেকে এমিকাসিন নামক একটি অ্যান্টিবায়োটিক এর বেশ কিছু ভায়াল পাওয়া গেছে এবং তার সঙ্গে মিলেছে কোভিশিল্ড ভ্যাকসিনের বেশ কিছু জাল লেবেল। জানা যাচ্ছে শিয়ালদা এলাকার কোন একটি জায়গা থেকে এই সমস্ত স্টিকার প্রিন্ট করিয়েছিল দেবাঞ্জন। ইতিমধ্যে কলকাতা পুলিশের তরফ থেকে শুক্রবার একটি স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম গঠন করা হয়েছে এই ঘটনার তদন্ত করার জন্য। এই ভ্যাক্সিনেশন ক্যাম্পে নিজের করোনা ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছিলেন তৃণমূল সাংসদ মিমি চক্রবর্তী। তিনি দেবাঞ্জন এর বিরুদ্ধে থানায় এফআইআর দায়ের করেন এবং এই সম্পূর্ণ চক্রের পর্দা ফাঁস করেছেন। জানা গিয়েছে, বর্তমানে মিমি চক্রবর্তী অত্যন্ত গুরুতর অসুস্থ। বর্তমানে তিনি বাড়িতে ডাক্তারের পরামর্শে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। অন্যদিকে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ঘটনায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ।

গতকাল পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করে তিনি দেবাঞ্জন এর বিরুদ্ধে অনিচ্ছাকৃত খুন এর মামলা দায়ের করার আর্জি জানিয়েছেন। তবে শুধুমাত্র রাজ্যের মধ্যে এই ঘটনা থেমে নেই, এই ঘটনা নিয়ে সোচ্চার হয়েছে বিরোধী দল বিজেপি। বিজেপির তরফ থেকে শুভেন্দু অধিকারী গতকাল সল্টলেকের স্বাস্থ্য ভবনে গিয়ে এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি জানিয়ে এসেছেন। সূত্রের খবর অনুযায়ী, তিনি কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধনকে চিঠি লিখে কোন স্বতন্ত্র কেন্দ্রীয় সংস্থার দ্বারা তদন্তের দাবি জানিয়েছেন, যার পরে কসবা ভুয়ো ভ্যাক্সিনেশন কান্ড নতুন মাত্রা পেয়েছে।