শ্রেয়া চ্যাটার্জি – বাংলাতে লোকসংস্কৃতি খনিজ ভান্ডার রয়েছে। কিন্তু সমস্যা একটাই যারা এই লোকগান গুলো তৈরি করেন তারা প্রত্যেকেই বিজ্ঞাপনের আড়ালে থাকেন, এটাই তো প্রকৃত শিল্পী। আছে এমন একটি নিদর্শন পাওয়া গেল রতন কাহারে লেখা বড়লোকের বিটি লো গানটাটিকে একটি চটকদার হিন্দি গানের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো গানটির যে আসল স্রষ্টা তার নাম উল্লেখ পর্যন্ত করা হলো না। অত্যন্ত একটি লজ্জার বিষয়। রতন কাহার এই নামটির সঙ্গে আমরা বাংলাতেও অনেকেই পরিচিত নয়। কারণ তিনি কোনদিনই প্রচারের আলোয় আসেনি। প্রচারের অন্ধকারে থেকে তিনি নীরবে কাজ করে গেছেন। বড়লোকের বিটি লো লম্বা লম্বা চুল গানটি আমরা অনেকেই শুনেছি কিন্তু আমরা কজন জানি এর স্রষ্টা রতন কাহারের কথা? অনেকেই জানিনা।
সব খবর মোবাইলে পেতে 👉🏻
Join Nowএই গানটি তৈরি হওয়ার পেছনে একটি ছোট্ট ইতিহাস আছে। একটি ছোট্ট মেয়ে তার এক ঢাল চুলে লাল ফিতে দিয়ে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে একজন মা তার করুণ কাহিনীর কথা একজন তরুণ লোক শিল্পীকে শোনাচ্ছিলেন, এই শিল্পী হলেন রতন কাহার। এই মা যে বাচ্চা মেয়েটির চুল বেঁধে দিয়েছেন তার কোনো পিতৃপরিচয় নেই অর্থাৎ মেয়েটির মায়ের যখন অল্প বয়স ছিল তখন কোন শহরের বাবু তাকে ভালোবাসার আশা দেখিয়ে চলে যান, তারপর এই মা যখন বুঝতে পারেন তার মধ্যে একটু একটু করে প্রাণের সঞ্চার হচ্ছে, তখন আর তার কিছু করার ছিল না কারণ সেই বড়বাবু তার পিতৃত্বকে মেনে নেননি। এই ঘটনা থেকে এমন গানের উৎপত্তি। তাই ওই বাচ্চা মেয়েটি হল বড় লোকের বেটি।
১৯৭৬ সালে গানটি প্রথম রেকর্ডিং করেন স্বপ্না চক্রবর্তী। এখনো পর্যন্ত বেশ জনপ্রিয় গান এবং গানটির জন্য জিতে নেন গোল্ডেন ডিস্ক পুরস্কার। শুধু তাই নয় রতন কাহার তৈরি করেছেন অজস্র ঝুমুর গান, পুরস্কার এবং শংসাপত্র তিনি এতটাই পেয়েছেন যে, একচিলতে তার ভাঙ্গা ঘরে সে সব রাখার জায়গা হয়নি। দারিদ্রতার সঙ্গে যুঝতে যুঝতে তিনি একটা সময় গান ছেড়ে দেন। ছেলে, মেয়ে সংসার নিয়ে তার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছিল। মেয়ে খুব ভাল গান গাইতেন, কিন্তু তাকে একটি হারমোনিয়াম পর্যন্ত কিনে দিতে পারেনি। পাহাড়ি সান্যাল, আর্য চৌধুরী, আনন্দ রাজকুমার সাহারা নিয়মিত তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। তবে নতুন প্রজন্মের মধ্যে শিলাজিৎ এর জন্য তিনি অনেক ভাদুগান লেখেন।
২০১৭ সালে কালিকাপ্রসাদ তার বাড়িতে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। তার কাছ থেকে অনেকেই গান নিয়ে গেছেন কিন্তু তাকে তার বিনিময়ে টাকা দিতে এলে তিনি বলতেন, গান তার কাছে মেয়ের মতন তাই ‘বেটি বেচে তিনি টাকা নিবেন না’। অসাধারণ এই ধরণের মানুষরা। এত জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা যিনি তিনি বেঁচে আছেন কি মারা গেছেন সে খবর এখন কেউ রাখেন না। অথচ সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে আমাদের প্রত্যেকের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়াটা এত সহজ হয়েছে, তা সত্ত্বেও কেন এই সমস্ত মানুষদের কথা আমরা জানতে পারি না! এর কোন উত্তর আমাদের কাছে নেই। তাঁরই গানকে নিয়ে যখন হিন্দিতে চটকদার গানের মাঝে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে এমনকি তার নামটা পর্যন্ত উল্লেখ করা হচ্ছে না, এর থেকে লজ্জার বিষয় বোধ হয় কিছুই হতে পারে না। বাংলা লোকসংস্কৃতি আমাদের দিয়েছে অনেক কিছু, কিন্তু আমরা তাদেরকে আজ কি ফিরিয়ে দিলাম? এ লজ্জা আমার আপনার, এ লজ্জা বাংলার। বাংলাকে বাঁচাতে গেলে তার সংস্কৃতিকে ধরে রাখার দায়িত্ব আমাদের। এই সমস্ত মানুষগুলি কালজয়ী সৃষ্টি না করলে বাংলার লোকসংস্কৃতি একেবারে তলিয়ে যেত।