সাক্ষাৎকার

পড়াশোনার পাশাপাশি মিষ্টি বিক্রি করে সংসারের একমাত্র রোজগেরে ১৩ বছরের সাহসী কিশোর

Advertisement

সংসারের হাল ধরতে মাত্র 13 বছর বয়সে দায়িত্ববান হয়ে উঠেছে বর্ধমানের সুমন। সুমনের বাড়ি বর্ধমানের মেমারির খারগ্রামে। বাবা , মা ও তিন বছরের এক বোনকে নিয়ে তাদের সংসার। ১৩ বছর বয়সী এই কিশোর পড়াশোনার পাশাপাশি সাইকেলে করে মিষ্টি বিক্রি করে। এত অল্প বয়সে পরিবারের প্রতি তার কর্তব্যবোধ রীতিমত প্রশংসনীয় ও আকর্ষণীয়।

আমাদের ভারত বার্তার প্রতিনিধি প্রীতম দাস যোগাযোগ করেছিল সুমন ও তার বাবা শরৎ ঘোষের সঙ্গে। তারা দুজনেই ভারত বার্তার প্রতিনিধি প্রীতম দাসের সঙ্গে বার্তালাপ করেন।

আজকাল অনেকসময় আমরা দেখতে পাই বা শুনতে পাই প্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানরা ঠিকমত সাংসারিক দায়িত্ব , কর্তব্য পালন করছে না। সেখানে এত আপনার ছেলে দায়িত্ববান হয়ে উঠেছে। এটা নিয়ে কী প্রতিক্রিয়া দিতে চাইবেন ?

শরৎ ঘোষ : সত্যি বলতে আমি ছেলের প্রতি খুবই গর্বিত। কারণ , আমি প্রায় তিন বছর চাপের কাজ কোনমতে করে উঠতে পারছি না। নার্ভের সমস্যার দরুন ডান পায়ের শিরায় প্রবল টান ধরে। একদিন কোন চাপের কাজ করলে দ্বিতীয় দিন কাজ করতে পারি না। আমি প্রায় ছয় মাস যাবৎ বিছানায় শয্যাশায়ী ছিলাম সুগার ও নার্ভের সমস্যার কারনে। সেই সময়টায় সুমন আমাকে বারবার বলত – ‘ বাবা তুমি তো পারছো না যেতে। তো আমি যদি মিষ্টিটা নিয়ে যাই , তাহলে বিক্রি করে আমাদের সংসার ভালোভাবে চলবে ‘। আমি তখন বললাম – ‘ দেখ বাবা তুই তো ছোট। কিভাবে যাবি ? কী করবি ! ‘ সুমন বলে – নাগো আমি পারবো।

সুমন যথারীতি সকালবেলা টিউশন পড়ে এসে বেরিয়ে পরতো মিষ্টি নিয়ে। মিষ্টি বিক্রি করে এসে আবার বই নিয়ে পড়তে বসতো। সত্যিই পড়াশোনার দিক থেকে ওর ক্যাপচার ক্ষমতা খুব ভালো। আমি নিজেও গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছি অ্যাকাউন্ট অনার্স নিয়ে। আমার নিজের খুব ইচ্ছা ছিল ছেলেকে প্রাইভেট কোন যদি স্কুলে পড়াতে পারি বা আমার থেকে ওকে যদি একটু উন্নত শিক্ষা দিতে পারি। ভাগ্যক্রমে আমি আগে অ্যাম্বুলেন্স চালাতাম। ডেয়ারী ফার্মের মত করেছিলাম।চাপের কাজ আর না করতে পারার জন্য চালাতে পারলাম না। সে কারণে এখন আমার সংসারের অবস্থা সত্যিই খুবই খারাপ , কোন ভাবে চলছে। সে জায়গায় দাঁড়িয়ে সুমন কিন্তু বারবার প্রচুর হেল্প করে দিয়েছে বা ও নিজে দায়িত্ব নিয়ে এই কাজগুলো করা , সংসারের বিভিন্ন রকম কাজগুলো ‘ বাবা এটা নেই বাবা ওটা নেই আমি যাচ্ছি , আমি মুদিখানা মালপত্র এনে দিচ্ছি , আমি রেশনটা এনে দিচ্ছি ‘। এই জিনিসগুলো আমি দেখেছি , লক্ষ করেছি খুব সহযোগিতা করে যা প্রশংসনীয়।


এহেন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে আপনি কি চান আপনার ছেলের পাশে , পরিবারের পাশে কেউ সাহায্যার্থে দাঁড়াক ?

শরৎ ঘোষ : হ্যাঁ অবশ্যই। আমি তো চাই আমার ছেলের পড়াশোনা টা যাতে ভালো করে চালিয়ে যেতে পারি। সেই হিসেবে কেউ যদি এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমাকে একটু আর্থিক সাহায্য করে তাহলে আমি কিন্তু খুব উপকৃত হব। আমি এটুকুই বলতে চাইছি যে , ওর পড়াশোনা খরচ বা আমাদের যে মিষ্টি বানাই , বিক্রি করি তো আমার এইটা যদি আরেকটু উন্নত মানের একটু করতে পারি বা কোন দোকান ভাড়া নিতে পারি। সেই হিসাবে কেউ যদি আমাকে একটু আর্থিক সাহায্য করে তাহলে আমি উপকৃত হব।

এখনো অব্দি কেউ কি আপনাদের পাশে দাঁড়িয়েছে বা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ?

শরৎ ঘোষ : তেমনভাবে সেরকম কিছু পায়নি তবে কিছু এনজিও সংস্থা , ইউটিউবে যে ভিডিওগুলো ছেড়েছে তাদের দ্বারা সামান্য কিছু সাহায্য – ছেলেটার পড়াশোনার জন্য কিছু বই-খাতা কেনার পয়সা এরকম লোকে দিয়েছে। না দেওয়া বলবো না , দেয়নিও বলবো না , দিয়েছে।

আপনার ছেলে সুমন বর্তমানে কোন শ্রেণীতে পড়াশোনা করে ?

শরৎ ঘোষ : ক্লাস সেভেনে পড়ে।

আপনার ছেলে যে এত অল্প বয়সে যে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে এর নেপথ্য কারণ হিসেবে কি আপনার শরীর খারাপ ?

শরৎ ঘোষ : হ্যাঁ , শরীর খারাপ। যে কারণে আমার আর্থিক অবস্থা দুর্বল। সেই কারণেই এই বিষয়টা ওর মাথার মধ্যে ঢুকেছে।

যেমনটা প্রথমে বললাম যে , আজকাল অনেকেই আছেন যারা প্রাপ্তবয়স্ক কিন্তু নিজেদের পারিবারিক দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে চায়না। সেখানে আপনার ছেলে পড়াশোনার পাশাপাশি সাংসারিক দায়িত্ব সামলাচ্ছে। আপনি বাবা হিসেবে কি সামাজিক বার্তা দিতে চাইবেন ?

শরৎ ঘোষ : সত্যিই তাই। আমাদের গ্রামেও আমি দেখি ওর থেকে অনেক বড় বয়সী ছেলে যারা কোনো কাজ না করে ফালতু ঘুরে বেড়ায় , ক্লাবে আড্ডা মারে। সে জায়গায় দাঁড়িয়ে আমার ছেলে প্রতি আমি গর্বিত বা প্রশংসা পাবার মতোই আমার ছেলে। এরকম ছেলে পাওয়া সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার।

আপনার ছেলে সুমন কটার সময় মিষ্টি নিয়ে বেরোয় মানে কতক্ষন ডিউটি করে ?

শরৎ ঘোষ : সকালবেলা টিউশন করে এসে স্নান খাওয়া দাওয়া সেরে বেরোয় , ৪ – ৫ ঘণ্টার মত ডিউটি করে।

আপনার শরীর খারাপের পরেই মিষ্টির ব্যবসাটা শুরু করেছিলেন ?

শরৎ ঘোষ : হ্যাঁ , কি করবো ? বাড়ি বসে থাকবো ! কাজ জানা ছিল এবং আমার স্ত্রীও এই কাজ জানে। আমি ও আমার স্ত্রী আমরা দুজনেই এই মিষ্টিগুলো বানাই। আমি সপ্তাহে দু – একদিন বের হই। বাকিটা সময় ওই বেরোচ্ছিল। এনজিও সংস্থা গুলো কিছু সাহায্য করেছে বা ওরা বারবার অনুরোধ করেছে আর যেনো মিষ্টি নিয়ে না যায়। ওর পড়াশোনার খরচ, বই – খাতা – পেন যা লাগবে আপনারা ফোন করবেন। এই আশ্বাস দিয়েছেন।

আপনি বললেন আপনার বেশ কিছু বছর ধরে শরীর খারাপ যাচ্ছে। তা আপনার শরীর খারাপের জন্য নিশ্চয়ই চিকিৎসার খরচ চলছে। এমন অবস্থায় দাঁড়িয়ে কি সেই চিকিৎসার ভারবহন আপনি করতে পারছেন ?

শরৎ ঘোষ : পারছি না। যে কারণে আমার আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এখন আমাকে ইনসুলিন নিতে হয়। এছাড়াও কিছু ট্যাবলেট হাবিজাবি মিলিয়ে প্রায় মাস গেলে প্রায় ছয় হাজার টাকার ওষুধ লাগে। তবে এই ওষুধ গুলো খেয়ে এখন এরইমধ্যে একটু সুস্থ আছি। নাহলে একবারে বিছানায় পড়ে গেছিলাম।

এরপর আমাদের ভারত বার্তার প্রতিনিধি প্রীতম দাস কথা বলে শরৎ ঘোষের পুত্র সুমনের সঙ্গে।


সুমন কেমন আছো ভাই ?

সুমন : হ্যাঁ , ভালো আছি।

তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে ?

সুমন : পড়াশোনা ভালই চলছে এখন।

তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও ?

সুমন : বড় হয়ে বাবার কষ্টটা দূর করতে চাই। বাবা – মা এত কষ্ট করে আমাকে বড় করছে , বাবা – মায়ের মুখ উজ্জ্বল করতে চাই।

ডাক্তার , ইঞ্জিনিয়ার , শিক্ষক এমন কিছু হবার ইচ্ছে রয়েছে ?

সুমন : হবার তো সবই ইচ্ছা রয়েছে কিন্তু সেটা দেখতে হবে।

মানে পরিস্থিতির উপর নির্ভর করছে ?

সুমন : হ্যাঁ , পরিস্থিতির উপর।

[সাক্ষাৎকার গ্রহণ : প্রীতম দাস ]

Related Articles

Back to top button